নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের একটি দেশ বাংলাদেশ। অন্যান্য জেলার তুলনায় আমাদের প্রিয় জন্মভূমি লক্ষ্মীপুর জেলায় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া অনেক উপভোগ্য। যেই সময় উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে শীতকালে কুয়াশার প্রভাবে চোখের সামনে দিগন্ত মনে হয়। একটানা কয়েকদিন সূর্যের দেখা নেই। তখনও আমাদের দৈনন্দিন কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটে না।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। আর মেঘনা হলো- সকল নদীর জননী। মেঘনা নদীর পাড়ে গেলেই দেখা যাবে এমন দীগন্ত যার কোন শেষ নেই। মুহুর্তের মধ্যে বিষাদগ্রস্ত ভুলে যাবে তার দুঃখ-বেদনা, ফিরে পাবে আনন্দের উচ্ছ্বাস। দখিনা বাতাস কেবল দেহকে হিমশীতল করবে না, অন্তরকেও করবে প্রশান্ত। নদীর স্রোতকে দেখে মনে হবে- এইতো আপনার জীবনের উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, হর্ষ-বিষাদ। এ যেনজীবনেরই প্রতিচ্ছবি। মনের একটি কোণে ইচ্ছা জাগে, জীবনের বাকি সময় এ স্রোতের মাঝেই কাটিয়ে দেই । এই নদীর গর্ভে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির মাছের বসবাস।
“নানা রঙ্গের রুপচাঁদা,সুরমা, মাইট্যা, বড় বাটা, বড় কাইক্কা, লাক্ষ্যা, ছুরি, বোম, বাইন, গুয়াকাটা, তাইল্লা,ফাইস্যা, রাঙা চইটকা, নাগরু, লইট্যা, বাইল্যা, হো বাইল্যা, পোয়া, গাঙ কৈ, যাত্রিক, চাপিলা, চেউয়া, লাল কাপিলা, কালো কাপিলা,শাপলা পাতা মাছ, গলদা চিংড়ি, ইলিশ, কেচকিসহ নাম না জানা শত প্রজাতির সামুদ্রিক ও নদীর মাছের জন্য লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার তিনটি ঘাট দিন দিন ব্যাপক পরিচিতি পাচ্ছে। ঘাটগুলো হচ্ছে, রামগতি বাজার ঘাট, আলেকজান্ডার সেন্ট্রাল খাল এবং টাংকি বাজার ঘাট।”১
মাছের রাজা ইলিশের কথা কে না জানে?মেঘনার বুকে মাথা গুঁজে থাকে অগণিত ইলিশ।
লক্ষ্মীপুরের ইলিশ অনন্য এক স্বাদের অধিকারী।
“রামগতি বাজার ঘাট, আলেকজান্ডার সেন্ট্রার খাল এবং টাংকি বাজার ঘাট শুধু এ তিনটি ঘাটেই প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার নদী ও সাগরের মাছ বিক্রি করা হয়।
এ তিনটি ঘাট ছাড়াও রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং রায়পুরে আরো ১৭টি ঘাট রয়েছে। “২
“আলেকজান্ডার সেন্ট্রার খাল সূত্র জানায়, ঘাটে সবাই পাইকারি ব্যবসায়ী। জেলেদের মাছ ডাকে উঠানোর পর পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা কিনে নেয়। পরে পোন হিসেবে (৮০টি এক পোন) ইলিশ বিক্রি করা হয় বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে। এরমধ্যে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত ৮০টি ইলিশ ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মাঝে মধ্যে এ পরিমাণ ওজনের ইলিশ ৭০-৮০ হাজার টাকাও বিক্রি করা হয়। আবার অনেক সময় দাম লাখেও ছুঁয়ে যায়।
অন্যদিকে রামগতির টাংকি বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও মৎস্য ব্যবসায়ী আবদুর রব বেপারী জানান, প্রতি মাসে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয় এ ঘাটে। এর মধ্যে প্রতিদিন আড়াই কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়। মাঝে মধ্যে ১০ কোটি টাকার ইলিশও বিক্রি হয়।”৩
এই নদীর মাছ শুধু আমাদের নয়, চাহিদা পূরণ করে বহিঃবিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের। এভাবেই এ নদীর অবদান রয়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
আমরা জানি, নদীর পলিমাটি দ্বারা ব-দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায় মাটির উর্বরতা বেশি। আমাদের লক্ষ্মীপুর জেলা বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী অঞ্চলে হওয়ায় মাটির উর্বরতা আরো অনেকগুণ বেশি। আমাদের দেশে যে সকল ফুল-ফল, শাক-সবজি উৎপন্ন হয়, তার প্রায় সবগুলোই এখানে পাওয়া যায়। ফুলের সৌরভে মন-প্রাণ উতলা হয়ে উঠে। ফলের ঘ্রাণে ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হয়ে যায়। শহর পেরিয়ে গেলেই, ফসল আর ফসলের সমারোহ নয়নযুগলকে মুগ্ধ করে দেয়। তখন ওয়ার্ডসওয়াথ কিংবা কিটসের স্মৃতিগুলো ম্লান হয়ে যায়। লক্ষ্মীপুরের নারিকেল-সুপারির কথা কে না জানে? নিত্যদিনের ব্যবহৃত সয়াবিন তেল তৈরি করায় যে , লক্ষ্মীপুরের উৎপন্ন সয়াবিনের অনেক বড় অবদান রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি না।
সারা বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে , তখন আমাদের ছোট্ট এই জেলাও তার ব্যত্যয় ঘটায়নি। লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মী মানুষগুলোও কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
লক্ষ্মীপুরের কৃতি সন্তানদের মধ্যে সর্বাগ্রে যার নাম স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন- সাবেক রাষ্ট্রপতি (১৯৭৪) ও জাতীয় সংসদের স্পিকার (১৯৭৩) মুহাম্মদুল্লাহ। স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর(১৯৭৪) এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী(১৯৭৫) ড. মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকারী ও তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ.স.ম. আবদুর রব আমাদের অনেক বড় একজন ব্যক্তিত্ব। মুনীর চৌধুরী ও কবীর চৌধুরীর কীর্তির কথা স্মরণ না করার কোন জোর নেই। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন আমাদের লক্ষ্মীপুরের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. মাকসুদ কামাল (স্যার) আমাদের এই অঞ্চলের কৃতি সন্তান। এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণকারী বিশ্বের দুঃসাহসী মানব-মানবীদের অন্যতম একজন হলেন লক্ষ্মীপুরের গর্ব নিশাত মজুমদার।৪ বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও লন্ডনের একটি মসজিদের খতিব মাওলানা তারেক মনোয়ার এবং আওলাদে রাসূল আনোয়ার হোসাইন তাহেরী জাবেরী আল-মাদানীর নাম স্মরণ করলেও আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়।
পরিশেষে, একথা বলতে হয় যে লক্ষ্মীপুর জেলা অনন্য ও অতুলনীয়। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। আর লক্ষ্মীপুরে জন্ম নেওয়া মানুষগুলোও এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রভাবে সোনার মানুষে, লক্ষ্মী মানুষে পরিণত হয়।
লেখক: মোঃ রাকিব হোসেন, ৩য় বর্ষ, সেশন; ২০১৭-১৮