জন্মভূমি ও জন্মস্থানের স্মৃতি মানুষের মনকে আবেগতাড়িত করে। যে মাটিতে জন্ম,যার আলো বাতাসে বড় হয়েছি,জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেখানে চিরকালের জন্য শায়িত হবো সেই জন্মভূমি প্রাণপ্রিয় লক্ষ্মীপুর।
লক্ষ্মীপুর জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্রগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এ জেলার উত্তরে চাঁদপুর, পূর্ব ও দক্ষিণে নোয়াখালী, পশ্চিমে মেঘনা নদী, ভোলা ও বরিশাল জেলা অবস্থিত।
রায়পুর,রামগঞ্জ, রামগতি ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৯ জুলাই লক্ষ্মীপুর মহকুমা এবং একই এলাকা নিয়ে ১৯৮৪ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারী গঠিত হয় লক্ষ্মীপুর জেলা।এই জেলার মোট আয়তন ১৪৫৬ বর্গ কিলোমিটার। এ জেলায় পাঁচটি উপজেলা রয়েছে। উপজেলা গুলো হলো -কমল নগর, রামগঞ্জ, রামগতি, রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর সদর।
শ্রী সুরেশ চন্দনাথ মজুমদার রাজপুরুষ যোগীবংশ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে লিখেছেন -দালাল বাজারের জমিদার রাজা গৌর কিশোর রায় চৌধুরী ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে রাজা উপাধি পেয়েছেন। তার পূর্বপুরুষরা ১৬২৯ থেকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দালাল বাজার আসেন।তার বংশের প্রথম পুরুষের নাম লক্ষ্মী নারায়ণ রায়(বৈষ্ণব) এবং রাজা গৌর কিশোরের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী প্রিয়া।অনেক ঐতিহাসিকের মতে, লক্ষ্মী নারায়ণ রায় লক্ষ্মী প্রিয়ার নামানুসারে লক্ষ্মীপুরের নাম করন করা হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লক্ষ্মীপুর ভুলুয়া রাজ্যের অধীন ছিল। মোঘল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে লক্ষ্মীপুরে একটি সামরিক স্থাপনা ছিল। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ এলাকায় প্রচুর পরিমানে লবণ উৎপন্ন হত এবং বাহিরে রপ্তানি হত। লবণের কারনে এখানে লবণ বিপ্লব ঘটে। স্বদেশী আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরবাসী স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ করে। এসময় মহাত্মা গান্ধী এ অঞ্চল ভ্রমন করেন। তিনি তখন প্রায়ই কাফিলাতলি আখড়া ও রামগঞ্জের শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে অবস্থান করতেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬ সালের জুন মাসে লক্ষ্মীপুর সফরে আসেন।
১৯৭১ সালের ৬ই জুলাই মুক্তিযুদ্ধারা লক্ষ্মীপুর শহরের রহমতখালী সেতুর কাছে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৭২ জন পাক সেনাকে হত্যা করে। ২৫শে অক্টোবর সদরের মীরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধা ও পাকসেনাদের এক সম্মুখ লড়াইয়ে পাকবাহিনীর মেজরসহ ৭০ জন সৈন্য ও ৪১ জন রেঞ্জার নিহত হয়।
রামগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর দীঘির পাড়ে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধাদের এক লড়াই সংগঠিত হয়। এই লড়াইয়ে বহুসংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। পরবর্তীতে পাকসেনারা ১৪জন মুক্তিযুদ্ধাকে আটক করে রামগঞ্জ ক্যাম্পে এনে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রামগতি উপজেলার জমিদার হাটের বাঁকে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধাদের লড়াইয়ে কয়েকজন রাজাকারসহ ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।
এই জেলার স্বাক্ষরতার হার ৪২.৯০%। এ জেলায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কলেজ,স্কুল এ্যান্ড কলেজ,কামিল মাদ্রাসা, ফাজিল মাদ্রাসা, দাখিল মাদ্রাসা, আইন কলেজ, হোমিও কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান abong ভোকেশনাল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট উল্লেখযোগ্য।
লক্ষ্মীপুর জেলার অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। এ জেলার প্রধান উৎপাদিত ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে ধান,গম,সরিষা, পাট,মরিচ, আলু,ডাল,ভুট্টা, সয়াবিন, আখ চীনাবাদাম। প্রধান ফলগুলো হলো আম,কাঁঠাল, কলা,পেঁপে, পেয়ারা, তাল,লেবু,নারিকেল, সুপারি,আমড়া, জাম।এই জেলা নারিকেল, সুপারি ও সয়াবিনের জন্য বিখ্যাত।
এ জেলার ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসমূহ হচ্ছে -কাঞ্চনপুর দরগা,খোয়া সাগর দীঘি,শ্রীরামপুর রাজবাড়ী, শ্রী গোবিন্দ মহা প্রভু জেও আখ্রা,সাহাপুর নীলকুঠি বাড়ি,রামগতির রানী ভবানী কামদা মাঠ,শহরের তিতা খাঁ জামে মসজিদ, মজুপুর মটকা মসজিদ, আব্দুল্লাহপুর জামে মসজিদ, দালাল বাজার জমিদার বাড়ি,রায়পুর জীনের মসজিদ, রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এশিয়ার বৃহত্তম), লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ (লক্ষ্মীপুর জেলার প্রথম শহীদ মিনার), লক্ষ্মীপুর স্টেডিয়াম উল্লেখযোগ্য।
পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রামগতি একটি উপযুক্ত স্থান। এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য খুবই মনোরম। রামগতি ভ্রমনের সময় পর্যটকেরা সেখানকার মহিষের দুধ তৈরি ঐতিহ্যেবাহী দইকে প্রাধান্য দেয়। এখানে কুয়াকাটার মত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। রংবেরঙের পালতোলা নৌকার সারি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। বন বিভাগের বিশাল বনায়ন কেয়া বনের সবুজ বেষ্টনী ও নজরে আসবে। মজু চৌধুরী ঘাট রায়পুর থেকে রামগতি সংলগ্ন এলাকা মেঘনা নদীর ইলিশ মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত।
এই জেলার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব-
- ★ নিশাত মজুমদার (প্রথম বাংলাদেশী নারী এভারেস্ট বিজয়ী)
- ★ আ স ম আব্দুর রব ( বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী,বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা উপাধি দানকারী, ডাকসুর সাবেক ভিপি,সাবেক মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ)
- ★ রুহুল আমিন (বাংলাদেশের ১৫ তম প্রধান বিচারপতি)
- ★ মুহাম্মদ উল্লাহ (বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং গণপরিষদের প্রথম স্পিকার)
- ★ আবুল আহসান (বিশিষ্ট কূটনীতিক এবং সার্ক এর প্রথম মহাসচিব)
- ★ আব্দুল মতিন চৌধুরী (পদার্থবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপ-উপাচার্য)
- ★ ড.এ এস এম মাকসুদ কামাল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য)
- ★ মফিজুল্লাহ কবীর (ইতিহাসবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপ-উপাচার্য)
- ★ আব্দুল হাকিম (বঙ্গীয় পরিষদ সদস্য ১৯৪৬ সাল)
- ★ আনোয়ার হোসেন খান (রাজনীতিবিদ)
- ★ সেলিনা হোসেন ( বিশিষ্ট কথা সাহিত্যক)
- ★ হোসনে আরা শাহেদ ( শিক্ষাবিদ ও লেখক)
- ★ মোহাম্মদ বদিউজ্জামান ( দুর্নীতি দমন কমিশন এর সাবেক চেয়ারম্যান)
- ★ মাহফুজ আহমেদ ( অভিনেতা)
- ★ তারিন জাহান ( অভিনেত্রী)
সুজলা- সুফলা, শস্য শ্যামলা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা আমাদের প্রিয় জন্মভূমি লক্ষ্মীপুর। আমাদের জেলা আমাদের অহংকার। এমন জেলায় জন্মগ্রহণ করে নিজেকে গর্বিত মনে হয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিনা কেন হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি লক্ষ্মীপুর জেলার জন্য।
লেখক: ইমরান হোসাইন
২য় বর্ষ