“বাঙ্গালী বাবু, বাঙ্গালী জাদু ও ভুখা বাঙ্গালী”। এই তিনটি বিশেষণে বাঙ্গালীদের বিশেষায়িত করেই ফরমান আলী শুরু করেছেন তাঁর এই বই। বাঙ্গালি বাবু মানে বাঙ্গালীর কিছু অংশ কেরানি, যাদের অধিকাংশই হিন্দু; বাঙ্গালী জাদু মানে বাঙ্গালীরা জাদু জানে; আর ভুখা বাঙ্গালী মানে বাঙ্গালীদের অধিকাংশই না খেয়ে থাকে। আর এই তিনটি বিশেষণ থেকেই ধারণা করা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ কিংবা সামরিক প্রশাসনের লোকজন বাঙ্গালীদের সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করতো।
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীরপ্রাক্তন জেনারেল। ফরমান আলী পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ছিলেন বাংলাদেশে। মূলত ঢাকার গভর্নর অফিসের সাথে সংযুক্ত থেকে বেসামরিক প্রশাসনের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ছিলেন ফরমান আলী, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বরের গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং তা বাস্তবায়নকারী হিসেবে মনে করা হয় পাকিস্তানি এই জেনারেলকে।
ফরমান যেহেতু পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পূর্ব বাংলায় ছিলেন, তাই এখানকার মানুষ, পরিবেশ – পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জানাশোনাও ছিলো অন্যান্য পকিস্তানিদের থেকে বেশি, যার সফল প্রয়োগ ঘটেছিলো ’৭১ এর যুদ্ধে।
১৯৭১ এ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই অঞ্চলে যে ভাগ্যবরণের স্বীকার হয়েছিলো, অবসরে যাওয়ার পর এই যুদ্ধের সাথে সংস্লিষ্ট সামরিক – বেসামরিক কর্তা–ব্যক্তিরা কলম ধরেছেন সেই যুদ্ধ নিয়ে। সেই সব বইয়ে যেমন বরাবরের মতোই নিজেদের নিয়ে আত্ম- অহমিকা, বাঙ্গালীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, ধর্মকে ইস্যু হিসেবে দাঁড় করানো, মুক্তিবাহিনীর অবদানকে অস্বীকার করা যেমন আছে, তেমনি কারো কারো বইয়ে আছে অনেক অপ্রিয় সত্য কথা। ফরমান আলীর ‘How Pakistan got Divided’ তেমনই এক বই।
এই বইয়ে ফরমান আলী যেমন অনেক অপ্রিয় সত্য কথা বলেছেন, তেমনি আছে কিছু ক্ষেত্রে লাগামছাড়া মিথ্যাচার। মাঝে মাঝে বলেছেন নানান অর্ধ সত্য কথা,কিছু ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন সীমাহীন চতুরতা, নিজেকে উপস্থাপন করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের অভিযানের ব্যাপারে একজন নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক এবং একই সাথে একজন মেধাবী ও প্রাজ্ঞ মানুষ হিসেবে। বইয়ের অসংখ্য জায়গায় আছে নানান স্ববিরোধীতা।
ফরমানের এই বই পড়লেই বুঝা যাবে ‘ভদ্রলোক’ সত্যিকার অর্থেই পড়াশুনা করতেন, ছিলো বিশ্লেষণমূলক চিন্তাভাবনা, বুঝতে পারতেন সমস্যার গভীরতা ও এর সমাধান বের করতে পারতেন ভালোভাবেই। তবে সেই জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার ব্যবহার বাস্তবে প্রয়োগ হয়েছে খুব কমই।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়জুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসকদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক যেসব ইস্যুতে অভিযোগ ছিলো, সেসব অভিযোগকে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই বইয়ে তিনি কোনো পাত্তাই দেন নি। বরং এসব অভিযোগকে কথিত অভিযোগ বলে সম্বোধন করেছেন, এবং কিছু অভিযোগের ক্ষেত্রে নানান কথায় সেগুলোকে ভুল এবং স্বাধীনতা স্বপক্ষের গোষ্ঠীসমূহকে এসব দাবীর মদদদাতা আখ্যা দিয়ে নিজের বক্তব্যকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন।

শেখ মুজিবকে কখনো তিনি সম্বোধন করেছেন ‘বন্ধুপ্রতিম’ বলে, আবার কখনো তিনি তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নিতাবাদী’ আখ্যা দিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের নানান অভাব-অভিযোগকে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘আংশিক সত্য’ ও ‘আংশিক বানোয়াট’ নামে। শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অন্যত্র তাঁর অভিযোগ ছিলো রকম, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শেষ পর্যন্ত অনুগত পাকিস্তানী ছিলো। কিন্তু তাদের নেতারা তাদেরকে বিভ্রান্ত ও তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।“
,৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি দাবী করেছেন পাকিস্তান সরকারের তৎপরতার কারণে একজন মানুষও ক্ষুধা, রোগ কিংবা অন্য কোনো মানব সৃষ্ট কারণে মারা যায় নি, যা ছিলো বাস্তবতার সাথে চূড়ান্ত মিথ্যাচার।
যদিও এই বইয়ে ফরমান দাবী করেছেন বারবার, যে ’৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ীদের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রয়োজন ছিলো এবং সামরিক অভিযান কোনো সমাধান নয়। আবার অন্যত্র তিনি বলছেন সামরিক অভিযান অবশ্যম্ভাবী হয়ে গিয়েছিলো, এবং এই অভিযানকে জাস্টিফাই করেছেন যা তাঁর বক্তব্যের স্পষ্ট স্ববিরোধীতা।
ফরমান আলী ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বাঙ্গালীদের বর্বর বলে সম্বোধন করেছেন, এবং নানা জায়গায় বাঙ্গালিদের হাতে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিকেরা নির্যাতন – নিপীড়ন, হত্যা-ধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু বাঙ্গালিদের উপর চলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নিপীড়নকে স্বীকারই করেন নি তিনি (এটা প্রায় সকল পাকিস্তানি জেনারেলদের বইতেই লক্ষ্যণীয়)। বরং বলেছেন এসব অভিযোগ ভূ্যা, ভিত্তিহীন, অতিরঞ্জিত, ভারতীয় এবং ইহুদীদের অর্থায়নে পরিচালিত মিডিয়ার অপপ্রচার!
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন। জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট’ নামের গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং তার বাস্তবায়নকারী হিসেবে পরিচিতি। সেই টিক্কা খানকে তিনি বলেছেন ঋজু, সৎ ও কোমল হৃদয়ের ভদ্রলোক হিসেবে।
তবে একটা বিষয় উল্ল্যেখ করার প্রয়োজন এখানে। গোলাম আযম এবং জামায়াতে ইসলামী যে এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহয়তা করেছিলো এবং শান্তি কমিটি তৈরিতে তাদের ভূমিকা ছিলো, তা এই বইয়ে ফরমান উল্ল্যেখ করেছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে চলা অভিযানের দায়ভার সম্পূর্ণভাবে তিনি চাপিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, আওয়ামী লীগ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির উপর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও যে দায় এড়াতে পারে না, সেই সম্পর্কে তিনি ন্যূনতম উল্ল্যেখ করেন নি।
এই বইয়ে ফরমান পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল এ কে নিয়াজিকে একজন অদক্ষ,খামখেয়ালি, দুশ্চরিত্র, লম্পট, অদূরদর্শী, সুবিধাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ( যদিও নিয়াজি তার বই ‘The Betrayal of East Pakistan’ এ নিজেকে একজন কৌশলী সামরিক অফিসার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবী করেছেন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় জয়ের পথে ছিলেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা, অদূরদর্শিতা এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর জয় হাত ফসকে গেছে।)
যদিও স্ববিরোধীতা আছে, তবে ফরমান আলী এই বইয়ে বারবার স্বীকার করেছেন পাকিস্তানের সমস্যাটা ছিলো রাজনৈতিক, এর সমাধানও করতে হতো রাজনৈতিকভাবেই, এবং এই ব্যখ্যা সম্পর্কে বিশ্লেষকরা অধিকাংশই একমত। একটা প্রতিকূল পরিবেশে, বিরুদ্ধ জনগণের সাথে এবং যে অঞ্চলের তিন পাশে ছিলো একটা ‘শত্রু’ রাষ্ট্র, যারা দীর্ঘদিন ছিলো একটা সুযোগের অপেক্ষায়, সেখানে সামরিক অভিযান অবশ্যই একটা ভুল পদক্ষেপ ছিলো।
ফরমান আলীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ, তা হলো ১৪ ডিসেম্বর বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ। নিয়াজি তার বই ‘The Betrayal of East Pakistan’ এ একই অভিযোগের তীর ফরমান আলীর দিকে নিক্ষেপ করেছেন। নিয়াজী উল্ল্যেখ করেছেন, ফরমানের অফিস থেকে ফরমানের একটা ডায়রি থেকে একটা লেখা উদ্ধার করা হয়েছিলো, যেখানে লেখা ছিলো, “পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল রক্তে রঞ্জিত করা হবে”। এই বইয়ে ফরমান এই অভিযোগ স্বীকার করেছেন যে এই লাইনটি তিনিই লিখেছিলেন। তবে এই লাইন লেখার পেছনে তিনি যে কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, তা রীতিমত হাস্যকর লেগেছে আমার কাছে। একই সাথে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী অপহরণ এবং তাদের হত্যার ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তিনি তা অস্বীকার করেছেন। যদিও তিনি যে যুক্তি এবং সাক্ষী-সাবুদ ব্যবহার করেছেন, সেই বক্তব্য প্রমাণের সুযোগ এখন আর নেই। কারণ সে সব মানুষের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই।
বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য, বাগাড়ম্বর এবং আত্মপ্রশংসা থাকলেও পাকিস্তানি অন্যান্য জেনারেলদের বই থেকে এই বই অনেক দিক থেকেই ভালো – সেটা মান, বিশ্লেষণ এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকে। কিছু সীমাবদ্ধতা যদিও রাও ফরমান আলী কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, হয়তো তা আশাও করি না, তারপরও ফরমান আলী এই বইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের এবং তাদের পলিসির ত্রুটিগুলো নিয়ে কথা বলেছেন, সমাধানের পথ ইংগিত করেছেন। তাই আমার মনে হয় যেসব পাঠকেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহুমাত্রিক লেখা পছন্দ করেন, তাদের জন্যে ফরমান আলীর এইবই অবশ্য পাঠ্য।
লেখক: ফারভেজ মোশাররফ, সেশনঃ ২০১৭ –১৮