জীবন সংক্ষিপ্ত কিন্তু জীবনের ইতিহাস বৃহৎ। সময়ের কাঠামোয় বাঁধলে জীবন ৬০-৭০ বছরের। এই ৬০-৭০ বছরের কথা সংক্ষিপ্ত করে লিখলেও কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বই লেখা হয়ে যাবে। আমার বয়সতো আর ৬০-৭০ হয়নি,তাই কয়েকশ শব্দে কিছু কথা বলতে চাই।তুমি রাগ করবে না তো?
আসলে এই করোনায় ঘরবন্দী সময়ে তোমার কথা যেমন মনে পড়ছে,মনে পড়ছে প্রিয় মানুষগুলোর কথা,শৈশব- কৈশোরের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।এই হাজারো কথা থেকে তোমাকে আমার জন্মভূমি লক্ষ্মীপুর জেলার কথা বলতে চাই।
আমার জন্ম ঐতিহাসিক লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায়।৮-১০ বছর এখানের আলো বাতাসেই বেড়ে উঠা।
শীতের সকালে কিংবা সন্ধ্যায় ফসল তোলা ক্ষেতের ধারে আগুন পোহানো,গ্রীষ্মের কাঠফাটা রৌদ্রে কর্মহীন শত ব্যস্ততার পর পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কেটে চোখ লাল করে উঠা যেন নিত্যকার ঘটনা।অবলীলায় বলা যায়,আমার শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে নানার বাড়িতে।সবার স্কুলের ছুটি শেষ হয় কিন্তু আমার স্কুলের ছুটি যেন অফুরন্ত।নানার বাড়ি খালার বাড়ি করে কেটে যেত মাস।নাজমা খালার হাতের ইলিশ মাছ ভুনা,বড় খালার হাতের কলিজা পিঠা, সাজু খালার হাতের বিভিন্ন ধরনের আচার আজও আমাকে সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই ভাবেই কেটে যায় দিনগুলো।
আমি তোমায় বলেছি “ঐতিহাসিক লক্ষ্মীপুর ” আমার জেলা লক্ষ্মীপুর।ইতিহাসে তুমি নাকি ভালো নম্বর তুলতে পারো না,তাই ইতিহাস তোমার ভালো লাগে না।কেন নম্বর তুলতে পারো না তাও তুমি জানো না।শুনেছি, মানুষ কোনো কারণ ছাড়া যে মানুষকে ঘৃণা করে তার প্রেমেই নাকি বেশি হাবুডুবু খায়।যাই হোক ইতিহাস বলছি,বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা লক্ষ্মীপুর।ঐতিহাসিকরা মনে করেন, লক্ষ্মীপুর অঞ্চল এক সময় বঙ্গোপসাগরের অংশ ছিলো।কালক্রমে চর জেগে উঠলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ চাষবাস উপলক্ষে এবং আরব দেশের বহিরাগতরা ব্যবসা বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জনবসতি গড়ে তোলে। নদীর ভাঙা-গড়া এবং প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থায় সংগ্রাম করেও লক্ষ্মীপুরের মানুষ টিকে আছে।
এই উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষের মতোই তোমাকে আমার লক্ষ্মীপুরে টিকে থাকতে হবে।প্রতিকূল অবস্থায়ও পাশে থেকো,পাশে রেখো।
ইতিহাস শেষ হয়নি আরো আছে।ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লক্ষ্মীপুর ভুলুয়া রাজ্যের অধীন ছিল।মুঘল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে লক্ষ্মীপুরে একটি সামরিক স্থাপনা ছিল।আচ্ছা মুঘল কারা জানো তো? সম্রাট আকবর ও তার বংশধরেরা।অনেকে যদিও আমার নামের আগে সম্রাট বলে, আমার খারাপ লাগে না। কারণ সাম্রাজ্যহীন সম্রাটের সম্রাজ্ঞী তুমি।সোডিয়াম ক্লোরাইড মানে লবণ উৎপাদনেও লক্ষ্মীপুরের নাম ডাক ছিলো।নিজেরা ব্যবহারের পর বাইরে রপ্তানি করতো।এখানে লবণ বিপ্লব ঘটেছিল।
ভাবতে পারো যেখানে তোমার আমার মাঝে রাজনৈতিক বোঝাপড়া নাই সেখানে অন্য রাজনীতির খবর রেখে লাভ কী? দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বুঝতে হলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বুঝতে হয়।আমাদের লক্ষ্মীপুর রাজনৈতিক দিক দিয়েও সক্রিয়।
স্বদেশী আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।ঐসময় মহাত্মাগান্ধী এই অঞ্চল ভ্রমণ করেন।তিনি তখন প্রায়ই রামগঞ্জ শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে অবস্থান করতেন।১৯২৬ সালের জুন মাসে প্রেমের কবি দ্রোহের কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লক্ষ্মীপুর সফর করেন।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এখানে পাক-হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সতের বার যুদ্ধ হয়।এখানে তিনটি স্মৃতি স্তম্ভ,দুইটি গণকবর ও একটি গণহত্যা কেন্দ্র পাওয়া যায়।
যারা জটিল ও কঠিন রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝে কিন্তু লক্ষ্মীপুরবাসী যে নোয়াখালীবাসী না তা বুঝেও ভুলে যান তাদের জন্য আরো কিছু তথ্য হচ্ছে, লক্ষ্মীপুর নামে সর্বপ্রথম থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬০ সালে।১৯৭৯ সালের ১৯ জুলাই রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নিয়ে মহকুমা গঠিত হয়।একই এলাকা নিয়ে ১৯৮৪ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় লক্ষ্মীপুর জেলা।
১৫৩৪.৭ বর্গ কিলোমিটারের এ-ই জেলাটিতে রয়েছে ৫ টি উপজেলা,৪ টি পৌরসভা,৫৮ টি ইউনিয়ন, ৪৭৪ টি মৌজা ও ৫৪৭ টি গ্রাম।
ইতিহাস শুনে শুনে তুমি হয়তো বিশাল বিস্তৃত আকাশপানে চেয়ে অনেক কিছুই ভাববে।সেই ভাবনার গভীরতা আরো বাড়াতে লক্ষ্মীপুরের দর্শনীয় কিছু স্থান সম্পর্কে বলছি।ইসহাক জমিদার বাড়ি, কামানখোলা জমিদার বাড়ি, দালাল বাজার জমিদার বাড়ি, জ্বীনের মসজিদ,মজু চৌধুরীর হাট,লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ,রায়পুর পুরাতন মসজিদ,রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষন কেন্দ্র। আমি ভাবছি পৃথিবী সুস্থ হলে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী এ-ই জায়গাগুলোকে হৃদয়ের ফ্রেমেবন্দী করতে।
আমাদের লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মী সন্তানেরা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে তাদের ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে।ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আব্দুর রব, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং গণপরিষদের প্রথম স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ, সার্ক এর প্রথম মহাসচিব আবুল আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল স্যার,বাংলাদেশের ১৫ তম প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন প্রথম বাংলাদেশী নারী এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার সহ আরো অনেক গুণীজন আমাদের লক্ষ্মীপুরের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন।
এতক্ষণ তো আমি আমার জেলার অনেক কথা তোমায় বলেছি।তুমি চাইলে ইট-পাথরের এই শহর ছেড়ে অনাবিল সৌন্দর্যের শস্য শ্যামল কোলাহলহীন প্রাকৃতিক লীলাভূমি এই লক্ষ্মীপুরের আলো-বাতাস আর জনপদের সাথে মিশে যেতে পারি।সুস্মিতা, যাবে আমার সাথে পান সুপারি আর নারকেলের শহরে!
লেখক: আকবর হোসাইন, বর্ষ: ৩য়, সেশন: ২০১৭-১৮