লক্ষ্মীপুর, শুনলেই মনে হয় যেন দেবী লক্ষ্মী স্বয়ং এখানে থাকেন। তার অকৃপণতার যেন এক বড় নিদর্শন এই লক্ষ্মীপুর জেলা। হয়ত কোন একসময় এই গল্পের সাথে মিল রেখেই এখানকার পন্ডিতগন নাম রেখেছিলেন ‘লক্ষ্মীপুর’।দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্তর্গত সবুজে ঘেরা নরম কাদামাটির জেলা লক্ষ্মীপুর। ‘লক্ষ্মী’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ধন সম্পদ বা সৌভাগ্যের দেবী (দুর্গাকন্যা ও বিষ্ণুপত্নী) এবং পুর অর্থ হলো শহর বা নগর। অর্থাৎ লক্ষ্মীপুর অর্থ ‘সম্পদ সমৃদ্ধ শহর বা সৌভাগ্যের নগরী।’
এই জেলার নামকরণের গল্পগুলোও সমৃদ্ধ। সর্বাধিক প্রচলিত মতটি উল্লেখ করেন শ্রী সুরেশ চন্দ্রনাথ মজুমদার তাঁর ‘রাজপুরুষ যোগীবংশ’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে। তিনি উল্লেখ করেন, দালাল বাজারের জমিদার রাজা গৌরকিশোর রায় চৌধুরীর বংশের প্রথম পুরুষের নাম লক্ষ্মীনারায়ন রায় এবং রাজা গৌরকিশোরের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া। কেউ কেউ ধারণা করেন এদের দুইজনের যে কারো নাম অনুসারে ‘লক্ষ্মীপুর’ নামকরণ করা হয়।কিন্তু এই লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মী যেন আর পেরে উঠছেন না স্রোতস্বিনী মেঘনার সাথে। তাঁর সমস্ত উজাড় করে দেবার পরেও এখানকার মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলছে।নামের মধ্যে সৌভাগ্যের কথা থাকলেও এ জেলার রামগতি এবং কমলনগরের মানুষের দুর্ভোগ এবং ভোগান্তির শেষ নেই। তাদের দুর্ভোগের মূল কারণ এ অঞ্চলের নদীভাঙন।
কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। এ নদী নিয়ে লেখক হুমায়ুন কবিরের “মেঘনার ঢল” নামে একটি বিখ্যাত কবিতা রয়েছে।
কবি লিখেন –
“শোন মা আমিনা, রেখে দেরে কাজ
ত্বরা করে মাঠে চল,
এল মেঘনার জোয়ারের বেলা এখনি
নামিবে ঢল।”
এ কবিতায় যেমন মেঘনার প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে তেমনি এ অঞ্চলে মেঘনার তান্ডবের আশঙ্কাও ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে।
চানক্য বলেছিলেন “প্রয়োজনের যা অতিরিক্ত তাই হল বিষ, সেটা হোক অর্থসম্পদ, যশ-খ্যাতি, সম্মান”।
এ ঢল যেমন সারাবছরের অন্নের সংস্থান করে দিচ্ছে, বাংলার দুর্লভ আর আবহমান বৈচিত্রের সৃষ্টি করছে তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই মেঘনার আগ্রাসী স্বভাব অন্নদাত্রী মৃত্তিকাকে শুষে নিচ্ছে নিজ গর্ভে। বেঁচে থাকার সম্বল আর শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও হারাতে হচ্ছে মেঘনার ভয়ঙ্কর ছোবলে। তাই শুধু গরু-মহিষ আনার চিন্তাই নয় বর্তমানে ত্বরা করে এ অঞ্চলের মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, ফসল-ফলাদি ও সরিয়ে নিচ্ছে।
আর এই মেঘনা নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেবীর সন্তানসম এই দুই উপজেলা। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন ডাইনোসরের মতো লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে এই দুটি বিপদাপন্ন উপজেলা।
সাধারণত বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে মেঘনা সবচেয়ে বেশি উত্তাল থাকে। আর এ সময় নদী গর্ভে সবচেয়ে বেশি জমি বিলীন হয়ে যায়। এ অঞ্চলের মানুষের জমি-জমা, কবর স্থান, মসজিদ, বিদ্যালয়, সব কিছু নদী ভাঙনের কবলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদী ভাঙনের ফলে ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা সর্বোপরি দারিদ্রতার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নদী ভাঙনের ফলে এ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুই উপজেলা মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ-শতাধিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্কুলগুলোর মধ্যে চর গেছ পার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর বালুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, আনোয়ার উল্লাহ শিকদার প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাদির পন্ডিতের হাট উচ্চ বিদ্যালয়, কাদির পন্ডিতের হাট সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা, সাহেবের হাট দারুল উলুম মাদ্রাসা, চর কালকিনি জুনিয়র হাই স্কুল, চর ফলকন উচ্চ বিদ্যালয়, কে. আলম প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালতলী উচ্চ বিদ্যালয়, হাজী গোলাম ব্যাপারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসাতুল বানাত অন্যতম। বর্তমানে বালুরচর উচ্চ বিদ্যালয় ও ভাঙনের মুখে।
শিক্ষালয়ের এ ভাঙ্গনের ক্ষতিকর প্রভাব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়ের উপরই পড়ছে।প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হলেও এ অঞ্চলে বিদ্যালয় গুলো নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বাবা-মা ভাঙন পরবর্তী দখল কাটিয়ে উঠার জন্য ছেলে মেয়েদেরকেও বিভিন্ন কাজে কর্মে দিয়ে দেয়। পেশাগত সংকটে পড়তে হচ্ছে অনেক শিক্ষককে। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
নদীর করাল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। এক ধাপ আগানো মানুষগুলো পিছিয়ে যায় আরো দুই ধাপ। নদী ভাঙনের ফলে চাষাবাদ যোগ্য কৃষি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে পশুচারণ ভূমিও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়ে।বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজন তিনবেলা খাবার খেতে পারে না।ভাঙনের মুখোমুখি বেশিরভাগ মানুষেরই জমি কেনার সামর্থ্য থাকে না। তারা আশ্রয় নেয় বিভিন্ন জায়গায়। কেউ বা বেড়ি বাঁধের পাশে, কেউবা খালের পাশে নিচু জায়গায়, মাথা গোঁজার ঠাঁই খোজে। কেউবা সড়কের পাশে, কেউবা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করেন। গবেষণায় বলছে ৬২ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়ে বাড়ি ঘর নির্মাণ করে এবং পরবর্তীতে ঋণের অর্থ শোধ করতে হিমশিম খেয়ে যায়। অনেকে বাসা ভাড়া করেও থাকা শুরু করে। নদী ভাঙন ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি হয় এ অঞ্চলের মানুষ। এসব দূর্যোগের কারণে রামগতির ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের ৯৩ শতাংশ আয় কমে যায় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজনকে সরকারিভাবে বিভিন্ন সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক কিংবা অন্যান্য জটিলতার কারণে নদী ভাঙন রোধ প্রকল্প অনুমোদনে সময় গড়াচ্ছে। সরকারি পদক্ষেপ, ক্ষতির তুলনায় অপর্যাপ্ত; প্রায় ৩২ কিলোমিটার এলাকা এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে।তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন সারথী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার কষ্ট ভুক্তভোগীরাই জানে, তারাই কেবল জানে দেবী লক্ষ্মীর ছায়া সরে যাওয়ার কষ্ট।
তথ্যসূত্রঃ
★Sarker, Subrata & M. Shahadat Hossain; Climate Change Disaster and community based mitigation options at Ramgati coast, Bangladesh; Agricultural science Research journal, Vol.2(6); Pp: 346-354; June 2012.
★ http:// Wikipedia.org
★বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: লক্ষ্মীপুর জেলা, বাংলা একাডেমী।
লেখক: রাশেদ হোসেন
শিক্ষাবর্ষঃ২০১৬-২০১৭